Friday, October 15, 2010

Shakib made a History ইতিহাস গড়ে সিরিজ জয়

ক্রিকেটার ড্যানিয়েল ভেট্টোরি জ্যোতিষী হলেও বোধ হয় খারাপ করতেন না। বাংলাদেশে পা দিয়েই যেটা আঁচ করতে পেরেছিলেন, সেই সর্বনাশটাই যে ঘটে গেল জীবনে! ঢাকায় এসে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, বাংলাদেশে সাকিবই তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। প্রথম ম্যাচটা সাকিবের অলরাউন্ড নৈপুণ্যের কাছে হারার পর কাল বাঁচা-মরার লড়াইয়েও যখন সেই সাকিবই নিউজিল্যান্ডের মূল হন্তারক, শোক লুকিয়ে ভেট্টোরি চাইলে গলা চড়িয়ে বলতে পারেন, ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম...।’
কাল ম্যাচের তিন বল বাকি থাকতে ৯ রানে চতুর্থ ওয়ানডেটা হেরে সিরিজ হারও নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর অবশ্য নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক অন্য সুরে গাইলেন। সাকিবের একার কৃতিত্ব নয়, বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিতে এসে তাঁদের এ রকম লজ্জায় ডোবা নাকি বাংলাদেশের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর নিজেদের ব্যর্থতার পরিণতি। তা ভেট্টোরির এ কথাটাও ঠিক। সাকিবকে নিয়ে পুরো বাংলাদেশ দলের কাছেই তো নানাভাবে হারল তাঁর নিউজিল্যান্ড! ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং—কোথায় এগিয়ে তারা বাংলাদেশের চেয়ে?
জেমি সিডন্সের কাছে এই সিরিজটা হতে পারে অন্য রকম এক সাফল্যের। বাংলাদেশের কোচ হওয়ার পর থেকে তাঁর চাওয়াগুলোর মধ্যে অন্যতম—দলটা যেন কারও একার ওপর নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে। দিনে দিনে সেই রূপটাই তো বেরিয়ে আসছে দলের! প্রথম জয়ের নায়ক সাকিব, এরপর শাহরিয়ার নাফীস আর সোহরাওয়ার্দীর যুগলবন্দী। কাল আবার মাহমুদউল্লাহ-ইমরুল কায়েসকে নিয়ে গ্যালারি-ভর্তি দর্শকের সামনে চলে এলেন সাকিবই।
ভেট্টোরি যা-ই বলুন, যে দিনটাকে সাকিব বলছেন ‘এখন পর্যন্ত ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন’, সেদিনে নায়ক তো আর অন্য কেউ নন! ব্যাট হাতে ওয়ানডেতে নিজের পঞ্চম সেঞ্চুরি, বল হাতে ৩ উইকেট—ম্যাচ বিচারকের রায়েই যখন ম্যাচের নায়ক বাংলাদেশ অধিনায়ক, ভেট্টোরির কথায় কী-ই বা আসে যায়। শ্বাসরুদ্ধকর জয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে ঢুকে পড়ার দিনে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিলেন সাকিব আল হাসান।
অথচ শুরুটা দেখুন, টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে ৪৪ রানে তৃতীয় আর ৯৭ রানে চতুর্থ উইকেট হারানোর পর বাংলাদেশ দলের পুরোনো চেহারাটাই ফুটে উঠছিল। বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের ম্যাচ নয়, মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম তখন যেন নিউজিল্যান্ডকে সিরিজে ফেরানোর অপেক্ষায়। সাকিবের আলো ছড়াতে শুরু করল এর পর থেকেই। সে আলোর নিচে একটু একটু করে চাপা পড়তে থাকল কিউই-স্বপ্ন।
পঞ্চম উইকেটে মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে ৫১ রানের জুটি গড়ে শুরুর বিপর্যয়টা সামলালেন। মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ৬৮ রানের পরের জুটিতে বাঁচিয়ে তুললেন সিরিজ জয়ের আশা। যে ১৫৭ মিনিট উইকেটে ছিলেন, সাকিবের মুঠোবন্দী ছিল প্রতিটা মুহূর্তই। হারলেও অভিষেক ওয়ানডেতে ৪৪ রানে ৩ উইকেট সান্ত্বনার হতে পারে হামিশ বেনেটের জন্য। কিন্তু নিজের দ্বিতীয় ওভারেই (ইনিংসের অষ্টম) রকিবুলকে বোল্ড করে প্রথম উইকেট পাওয়ার আনন্দটা বেশিক্ষণ স্থায়ী করতে পারেননি। উইকেটে এসে পরের বলেই বেনেটকে স্কয়ার লেগ দিয়ে সাকিবের বাউন্ডারি, এর পর থেকে ম্যাচটাই হয়ে যায় সাকিবের। ৬০ বলে ৫০ করার পর ব্যাট তুললেন না আরও বড় কিছুর প্রতিজ্ঞায়। সেই বড় কিছু এল ইনিংসের ৪১তম ওভারে, ড্যানিয়েল ভেট্টোরিকে ফ্লিকে বাউন্ডারি মেরে। ১১৩ বলে ১০৬ রান করে সাকিব আউটও হয়েছেন ভেট্টোরিকে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে। অবিবেচক এক দর্শক অবশ্য তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়েছিলেন ৯২ রানের সময়ই। সাইটস্ক্রিনের পেছনে চলে আসা ওই দর্শককে বারবার ওখান থেকে সরে যেতে বলা হলেও নড়ছিলেন না তিনি। এসব দেখার জন্য মিরপুর স্টেডিয়ামে ওয়াকিটকি হাতে অনেককেই ঘুরে বেড়াতে দেখা গেলেও ওই মুহূর্তে ত্যক্ত-বিরক্ত সাকিবকেই উইকেট ছেড়ে ছুটে যেতে হয়েছে বাউন্ডারির দিকে।
অস্তিত্ব রক্ষার ম্যাচে ব্যাপক রদবদল হয়েছে নিউজিল্যান্ড দলে। ইনজুরিতে পড়া স্টুয়ার্টের জায়গায় কেন উইলিয়ামসন, ম্যাকাইর জায়গায় ড্যারিল টাফি, জেসি রাইডারের জায়গায় অ্যারন রেডমন্ড এবং টিম সাউদির জায়গায় বেনেট। বল হাতে বেনেট-টাফি খারাপ করেননি। ব্যাট হাতে নিউজিল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে উইলিয়ামসন করলেন প্রথম সেঞ্চুরি। তাতে কী? বাংলাদেশের ২৪১ রান তার পরও অস্পর্শনীয়ই হয়ে থাকল তাঁদের জন্য।
আসলে বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব আর অলরাউন্ড নৈপুণ্যের মিশেলে সাকিবই অস্পর্শনীয় করে রাখলেন সেটা। ৮০ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে নিউজিল্যান্ড যখন নিশ্চিত পরাজয়ের দিকে, ষষ্ঠ উইকেটে ৭০ রানের জুটি গড়ে পরিস্থিতি কিছুটা সামলে তুলেছিলেন উইলিয়ামসন আর গ্রান্ট এলিয়ট। এরপর নাথান ম্যাককালামের সৌজন্যে ম্যাচটা শেষ ওভার পর্যন্ত গেলেও রেডমন্ড-এলিয়টদের ফিরিয়ে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল সাকিবের বাঁহাতি ঘূর্ণি। সঙ্গে জুলিয়েন ফাউন্টেনের ছাত্রদের দুর্দান্ত সব ফিল্ডিং তো ছিলই। সাকিবের বলে এলিয়টের ক্যাচটা ৩০ গজের ভেতর থেকে পেছনে দৌড়ে যে দক্ষতায় হাতে পুরলেন রাজ্জাক, সেটা একটু হলেও মনে করিয়ে দিয়েছে ’৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে মদন লালের বলে কপিল দেবের নেওয়া ভিভ রিচার্ডসের দুর্দান্ত সেই ক্যাচটাকে। শেষ দিকে শট ফাইন লেগে শাহরিয়ার নাফীসের দু-দুটো দুর্দান্ত ফিল্ডিং কিংবা ডিপ মিড উইকেট থেকে বদলি ফিল্ডার নাঈম ইসলামের সরাসরি থ্রোতে নাথান ম্যাককালামের রান আউট বাংলাদেশের ফিল্ডিংয়ের বদলে যাওয়া চেহারাটাই তো দেখাল!
তার পরও শেষ ওভারের উত্তাপ ছড়িয়েছে ম্যাচ। জিততে হলে ১ ওভারে ১৬ রান দরকার ছিল নিউজিল্যান্ডের, হাতে ১ উইকেট। শফিউলের প্রথম বলটা লেগ সাইডে ঠেলে দিয়ে উইলিয়ামসনের ২ রান, পরের বলটা মিড উইকেট দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন বাউন্ডারির বাইরেই। ৪ বলে ১০ রান তুলতে আরও বাউন্ডারি মারতেই হতো। তৃতীয় বলে শফিউলকে ডিপ মিড উইকেট দিয়ে তুলে মেরে সেই চেষ্টাই করেছিলেন উইলিয়ামসন। কিন্তু রকিবুলের ক্যাচ ম্যাচ শেষ করে দিল ওখানেই।
একটা ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেসে গেছে। আরেকটা ম্যাচ এখনো হয়ইনি। তার পরও তিন ম্যাচের তিনটিতেই জিতে পূর্ণ শক্তির কোনো বড় দলের বিপক্ষেও বাংলাদেশ এখন সিরিজ-জয়ী দল!
সিরিজ শুরুর আগে এই ভবিষ্যৎটাও কি দেখতে পেয়েছিলেন ড্যানিয়েল ভেট্টোরি?

1 comment: